প্রায় এক শতাব্দি হতে চলল, আমাদের থেকে খিলাফত বিদায় নিয়েছে। ইসলামের সূচনাকাল থেকেই কুফফার গোষ্ঠীর প্রথম ও প্রধান টার্গেট ছিল খিলাফতের মূলোৎপাটন। যুগে যুগে বিভিন্ন রকমের ষড়যন্ত্র ও কূটকৌশলের মাধ্যমে তারা খিলাফত ধ্বংসের চেষ্টা করেছে। এতে কখনো সাময়িক সফলতা পেলেও পরে আবার ঠিকই খিলাফত ফিরে এসেছে। অনেক দুর্বলতা ও সমস্যা থাকা সত্ত্বেও মুসলিমদের খিলাফত টিকে ছিল দীর্ঘ তেরো শতাব্দিকালেরও অধিক সময় ধরে। শেষে এ উম্মাহ থেকে যখন কল্যাণের সর্বশেষ বিন্দুটুকুও আল্লাহ উঠিয়ে নিলেন, তখন খিলাফতব্যবস্থা একেবারে ভেঙে পড়ল। এরপর থেকে দীর্ঘ সময় অতিক্রান্ত হয়ে গেছে, কিন্তু ভুলভাবে চেষ্টা করায় সে খিলাফত আর ফিরে আসেনি। খিলাফত-পরবর্তী এ শতাব্দিতে বিশ্বকে শাসন করেছে কুফফার গোষ্ঠী ও তাদের তাবেদার নামধারী কিছু মুসলিম নামের মুরতাদরা। আর এ সময়টিতেই তারা মুসলমানদের ইমান-আকিদা ও নৈতিকতার ওপর আঘাত হেনেছে পূর্ণ শক্তিতে। এক্ষেত্রে তাদেরকে অনেকটা সফলও বলা যায়। বর্তমানে আমরা চারদিকে মুসলিম নামে যাদের দেখি, তাদের অধিকাংশেরই আজ না ঠিক আছে আকিদা, না আছে সঠিক ইলম, আর না আছে নৈতিকতা। বরং ইদানিং তো অনেকের ইমানও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যাচ্ছে এবং কারও কারও ইমান চলেও যাচ্ছে। আল্লাহর কাছে আমরা এ ভয়ংকর ফিতনা থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করি।
দীর্ঘদিন ধরে কাফিরদের শাসনব্যবস্থায় থাকার কারণে বর্তমান উদারমনা মুসলিমদের মনে একটি বাতিল আকিদা বদ্ধমূল হয়ে গেছে যে, মানবতা আগে, ধর্ম পরে। মানুষ পরিচয় প্রথমে, অন্য পরিচয় দ্বিতীয় স্তরে। মানবতার জয়গান গেয়ে তারা তাদের দুনিয়ার প্রভুদের খুশি করার চেষ্টায় ব্যস্ত থাকে; আর ওদিকে তাদের প্রভুরা তাদেরই জ্ঞাতি ভাইদের হত্যা, বোনদের ধর্ষণ, শিশুদের নির্যাতন ও মুসলিম জনপদ বিরান করতে ব্যতিব্যস্ত থাকে। এতসব অপকর্ম সেরে মিডিয়ায় আবার উল্টো প্রচার করে যে, পুরো বিশ্বে তারা শান্তির বার্তা পৌঁছিয়ে দিচ্ছে। তাদেরকে যারা বাধা দিচ্ছে, তারা হলো টেরোরিস্ট, তারা হলো আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী। আমাদের বোকা মুসলিম জাতিও তাদের এ শেখানো বুলি গোগ্রাসে গিলছে। তাদের প্রতিটি কথা অন্তর থেকে বিশ্বাস করে নিচ্ছে। এভাবেই পুরো পৃথিবীজুড়ে কুফফার গোষ্ঠী শুধু আমাদের জাগতিক স্বাধীনতাই ছিনিয়ে নেয়নি; বরং আমাদের সবচেয়ে দামী সম্পদ ইমান ও বিশুদ্ধ আকিদাও ছিনিয়ে নিয়েছে। চতুর্মুখী এ লাঞ্ছনার সময়ে যারা উম্মাহকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে এবং সকল আরাম-আয়েশ ত্যাগ করে তাদেরকে বাস্তবতা ও সত্যিটা বুঝানোর চেষ্টা করছে, তখন নিজেদের লোকেরাই তাঁদেরকে উগ্রপন্থী, নির্দয় ও ক্ষেত্রবিশেষে সন্ত্রাসী ট্যাগেও অভিহিত করছে। হায়! গোলামির এ জিঞ্জির যে শুধু দেহকেই নয়; বরং অন্তরসহ আমাদের পুরো অস্তিত্বকেই বন্দি করে ফেলেছে!
আজ আসুন, একটু খোলা মনে এ বিষয়টি নিয়ে ভেবে দেখি, কাফিরদের ব্যাপারে আমাদের এ নমনীয়ভাব আমাদের ইমানের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে না তো! কাফিরদের ব্যাপারে আমরা কেমন আকিদা ও মনোভাব রাখব এবং তাদের বিপদাপদে, মৃত্যুতে বা কষ্টে খুশি হওয়া যাবে কিনা, সে ব্যাপারটিতে অনেক মুসলিম ভাই-ই চিন্তায় থাকেন। তাদের জন্যই মূলত আমাদের আজকের আলোচনা। আর যারা এসব নিয়ে চিন্তা করেন না, যারা ইসলামের ওপর মানবতার ধর্মকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকেন, যারা পূর্ব থেকেই নিজেদের উদার ভেবে থাকেন এবং আজীবন নিজেদের আবিষ্কৃত উদারতার ওপরই অটল থাকতে চান, তাদের নিয়ে আমাদের কোনো কথা নেই। তাদের রাস্তা আর আমাদের রাস্তা ভিন্ন। আমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের দেখানো পথকেই প্রথম ও চুড়ান্ত হিসেবে বিবেচনা করি। সাহাবায়ে কিরাম রা. যেভাবে তাঁদের প্রিয় রাসুলের আদেশ-নিষেধ বাস্তবায়ন করেছেন, সেটাকেই আমরা সঠিক ও নির্ভুল পদ্ধতি মনে করি। আর পরবর্তী সালাফ তাঁদের থেকে কুরআন-সুন্নাহ যেভাবে বুঝেছেন এবং পরবর্তী প্রজন্মকে বুঝিয়েছেন, আমরা সেসব বুঝকেই আমাদের দ্বীন ও আকিদার জন্য নিরাপদ মনে করি। এ ভিত্তিতেই আজ আমরা মূল আলোচনা শুরু করতে যাচ্ছি। আশা করি, এতে সত্যানুসন্ধানীদের জন্য থাকবে পর্যাপ্ত খোরাক, আর সংশয় পোষণকারীদের জন্য থাকবে সকল সংশয়ের নিরসন, ইনশাআল্লাহ।
ব্যাপকভাবে কাফিরদের সাথে কঠোরতা
আল্লাহ তাআলা বলেন :
مُّحَمَّدٌ رَّسُولُ اللَّهِ وَالَّذِينَ مَعَهُ أَشِدَّاءُ عَلَى الْكُفَّارِ رُحَمَاءُ بَيْنَهُمْ
‘মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসুল। আর তাঁর সহচরগণ কাফিরদের ব্যাপারে কঠোর এবং নিজেরা পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল।’ (সুরা আল-ফাতহ : ২৯)
এ আয়াতে আল্লাহ তাআলা সাহাবিদের গুণের প্রশংসা করে বলছেন যে, তাঁরা কাফিরদের ব্যাপারে কঠোর। এখানে কাফির বলতে সব শ্রেণির কাফিরের কথাই বুঝানো হয়েছে। কেননা, এর الْكُفَّارِ মধ্যে ‘আলিফ-লাম’ জিনসি বা ইসতিগরাকি। জিনসি হলে অনুবাদ হবে, ‘তাঁরা কাফির জাতির ওপর কঠোর।’ আর যদি ইসতিগরাকি নেওয়া হয়, তাহলে অর্থ হবে ‘তাঁরা সকল কাফিরের ব্যাপারে কঠোর।’এ সমস্ত ক্ষেত্রে সাধারণত ইসতিগরাকির অর্থ নেওয়াকে উত্তম মনে করলেও যারা সূক্ষ্মভাবে ভাবতে পারেন, তারা জানেন, এখানে ইসতিগরাকির চাইতে জিনসির অর্থ নেওয়াই বেশি উত্তম। উভয়টির মধ্যে সূক্ষ্ম একটি পার্থক্য রয়েছে, যা ইলমুল বালাগাত সম্বন্ধে প্রাজ্ঞ আলিম ছাড়া সাধারণদের বুঝা কষ্টকর হবে। মোটকথা, যে অর্থই নেওয়া হোক না কেন, এখানে ব্যাপকতা বুঝাচ্ছে। ব্যাপকভাবে কাফিরদের ব্যাপারে সাহাবায়ে কিরামের মনোভাব এমন কঠোরই ছিল। তাঁরা সাধারণভাবে কাফিরদের সাথে নমনীয়ভাব দেখাতেন না, তাদের সামনে হাসিখুশি থাকতেন না এবং তাদের ক্ষেত্রে শরিয়া-অনুনোমদিত ও অপ্রয়োজনীয় কোনো ছাড় দিতেন না।
আল্লামা ইবনে কাসির রহ. এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন :
وَهَذِهِ صِفَةُ الْمُؤْمِنِينَ أَنْ يَكُونَ أَحَدُهُمْ شَدِيدًا عَنِيفًا عَلَى الْكَفَّارِ، رَحِيمًا بَرًّا بِالْأَخْيَارِ، غَضُوبًا عَبُوسًا فِي وَجْهِ الْكَافِرِ، ضَحُوكًا بَشُوشًا فِي وَجْهِ أَخِيهِ الْمُؤْمِنِ
‘এটাই হলো মুমিনদের বৈশিষ্ট্য যে, তাদের প্রত্যেকেই কাফিরদের ব্যাপারে কঠোর ও অনমনীয় হবে, আর নেককার মুমিনদের ক্ষেত্রে সদয় ও উত্তম আচরণকারী হবে। কাফিরের সামনে ক্রোধান্বিত ও রূঢ় থাকবে, আর তার মুমিন ভাইয়ের সামনে সদাহাস্য ও প্রফুল্ল থাকবে।’ (তাফসিরু ইবনি কাসির : ৭/৩৩৭, প্রকাশনী : দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যা, বৈরুত)
আল্লাহ তাআলা বলেন :
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا مَنْ يَرْتَدَّ مِنْكُمْ عَنْ دِينِهِ فَسَوْفَ يَأْتِي اللَّهُ بِقَوْمٍ يُحِبُّهُمْ وَيُحِبُّونَهُ أَذِلَّةٍ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ أَعِزَّةٍ عَلَى الْكَافِرِينَ يُجَاهِدُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَلَا يَخَافُونَ لَوْمَةَ لَائِمٍ ذَلِكَ فَضْلُ اللَّهِ يُؤْتِيهِ مَنْ يَشَاءُ وَاللَّهُ وَاسِعٌ عَلِيمٌ
‘হে মুমিনগণ, তোমাদের মধ্যে যে স্বীয় ধর্ম থেকে ফিরে যাবে, (তাহলে জেনে রেখো,) অচিরেই আল্লাহ এমন সম্প্রদায় সৃষ্টি করবেন, যাদেরকে তিনি ভালোবাসবেন এবং তারাও তাঁকে ভালোবাসবে। তারা মুমিনদের প্রতি হবে কোমল এবং কাফিরদের প্রতি হবে কঠোর। তারা আল্লাহর পথে জিহাদ করবে এবং কোনো নিন্দুকের নিন্দার ভয় করবে না। এটি আল্লাহর অনুগ্রহ, তিনি যাকে ইচ্ছা দান করেন। আল্লাহ প্রাচুর্যময়, মহাজ্ঞানী।’ (সুরা আল-মায়িদা : ৫৪)
এ আয়াতে الْكَافِرِينَ শব্দটি বহুবচন, যাকে আরবিতে ‘আল-জামউস সালিম’ বলা হয়। ‘আল-জামউস সালিম’-এর ক্ষেত্রে আরবি ভাষাশাস্ত্রের একটি মূলনীতি হলো, এতে ব্যবহৃত ‘আলিফ-লাম’ ইসতিগরাকির জন্য আসে। সুতরাং এখানে অর্থ হবে, সকল কাফিরের ওপর। এ থেকে আংশিক বা কতিপয় কাফির অর্থ বুঝার কোনো সুযোগ নেই। নাহু, সরফ, ইশতিকাক ও বালাগাত সম্বন্ধে প্রাজ্ঞ সকল আলিমের এ মূলনীতিটি জানা আছে। এ আয়াতে আল্লাহ তাআলা যেসব মুমিনকে ভালোবাসেন, তাঁদের কিছু বৈশিষ্ট্যের কথা বলেছেন। প্রথম বৈশিষ্ট্যই হলো, মুমিনদের প্রতি সদয়ভাব ও কাফিরদের সাথে কঠোরভাব। অর্থাৎ যেসব মুমিন কাফিরদের সাথে কঠোরতা দেখায় এবং শত্রুতা পোষণ করে, পাশাপাশি মুমিনদের প্রতি সদয় আচরণ করে, তাঁদেরকে আল্লাহ তাআলা ভালোবাসেন। মুমিনদের এ পারস্পরিক হৃদ্যতা অনেকটা পিতা-পুত্রের হৃদ্যতার মতো, আর কাফিরদের সাথে তাদের মনোভাব অনেকটা শিকার ও শিকারির মতো।
ইমাম কুরতুবি রহ. এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন :
قَوْلُهُ تَعَالَى: (أَذِلَّةٍ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ) ” أَذِلَّةٍ” نَعْتٌ لِقَوْمٍ، وَكَذَلِكَ” (أَعِزَّةٍ) ” أَيْ يَرْأَفُونَ بِالْمُؤْمِنِينَ وَيَرْحَمُونَهُمْ وَيَلِينُونَ لَهُمْ… وَيَغْلُظُونَ عَلَى الْكَافِرِينَ وَيُعَادُونَهُمْ. قَالَ ابْنُ عَبَّاسٍ: هُمْ لِلْمُؤْمِنِينَ كَالْوَالِدِ لِلْوَلَدِ وَالسَّيِّدِ لِلْعَبْدِ، وَهُمْ فِي الْغِلْظَةِ عَلَى الْكُفَّارِ كَالسَّبُعِ عَلَى فَرِيسَتِهِ
‘আল্লাহর বাণী “মুমিনদের প্রতি হবে কোমল” এটা قَوْمٍ বা “সম্প্রদায়” এর সিফাত (গুণ), অনুরূপ “কাফিরদের প্রতি হবে কঠোর” কথাটিও (قَوْمٍ বা “সম্প্রদায়” এর সিফাত)। অর্থাৎ মুমিনরা মুমিনদের প্রতি সদয় হবে, তাদের প্রতি দয়া দেখাবে এবং নম্র হবে। …আর তাঁরা কাফিরদের ব্যাপারে কঠোরতা দেখাবে এবং তাদের সাথে শত্রুতা রাখবে। ইবনে আব্বাস রা. বলেন, “মুমিনরা মুমিনদের জন্য পিতা-পুত্র ও মনিব-গোলামের মতো, আর কাফিরদের ওপর কঠোরতার ক্ষেত্রে তাঁরা শিকারের ওপর হিংস্র প্রাণীর মতো।’ (তাফসিরুল কুরতুবি : ৬/২২০, প্রকাশনী : দারুল কুতুবিল মিসরিয়্যা, কায়রো)
আল্লাহ তাআলা বলেন :
لَا تَجِدُ قَوْماً يُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ يُوادُّونَ مَنْ حَادَّ اللَّهَ وَرَسُولَهُ وَلَوْ كانُوا آباءَهُمْ أَوْ أَبْناءَهُمْ أَوْ إِخْوانَهُمْ أَوْ عَشِيرَتَهُمْ أُولئِكَ كَتَبَ فِي قُلُوبِهِمُ الْإِيمانَ وَأَيَّدَهُمْ بِرُوحٍ مِنْهُ وَيُدْخِلُهُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهارُ خالِدِينَ فِيها رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمْ وَرَضُوا عَنْهُ أُولئِكَ حِزْبُ اللَّهِ أَلا إِنَّ حِزْبَ اللَّهِ هُمُ الْمُفْلِحُونَ
‘যারা আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস করে, তাদেরকে আপনি আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের বিরুদ্ধাচরণকারীদের সাথে বন্ধুত্ব করতে দেখবেন না; যদিও তারা তাদের পিতা, পুত্র, ভ্রাতা অথবা জ্ঞাতিগোষ্ঠী হয়। তাদের অন্তরে আল্লাহ ইমান লিখে দিয়েছেন এবং তাদেরকে শক্তিশালী করেছেন তাঁর অদৃশ্য শক্তি দ্বারা। তিনি তাদেরকে জান্নাতে দাখিল করবেন, যার তলদেশে নদী প্রবাহিত। তারা তথায় চিরকাল থাকবে। আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট এবং তারা আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট। তারাই আল্লাহর দল। জেনে রেখো, আল্লাহর দলই সফলকাম হবে।’ (সুরা আল-মুজাদালা : ২২)
এ আয়াতে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের বিরুদ্ধাচরণকারীদের সাথে মুমিনদের কোনো বন্ধুত্ব ও হৃদ্যতা থাকতে পারে না বলে স্পষ্ট বিবরণ এসেছে। চাই তারা কাফির হোক কিংবা নামধারী মুসলিম হোক, নিকটাত্মীয় হোক, দূরসম্পর্কীয় হোক কিংবা অপরিচিত হোক; সবার ক্ষেত্রে একই বিধান। এ আয়াতের ব্যাপকতা কেবল কাফিরদেরকেই নয়; বরং সীমালঙ্ঘনকারী ও জালিম শ্রেণির মুসলিমদেরকেও শামিল করেছে। অর্থাৎ এদের কোনো শ্রেণির প্রতিই দয়ামূলক আচরণ বা হৃদ্যতা দেখানো যাবে না।
ইমাম কুরতুবি রহ. এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন :
اسْتَدَلَّ مَالِكٌ رَحِمَهُ اللَّهُ مِنْ هَذِهِ الْآيَةِ عَلَى مُعَادَاةِ الْقَدَرِيَّةِ وَتَرْكِ مُجَالَسَتِهِمْ. قَالَ أَشْهَبُ عَنْ مَالِكٍ: لَا تُجَالِسِ الْقَدَرِيَّةَ وَعَادِهِمْ فِي اللَّهِ، لِقَوْلِهِ تَعَالَى: لَا تَجِدُ قَوْماً يُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ يُوادُّونَ مَنْ حَادَّ اللَّهَ وَرَسُولَهُ. قُلْتُ: وَفِي مَعْنَى أَهْلِ الْقَدَرِ جَمِيعُ أَهْلِ الظُّلْمِ وَالْعُدْوَانِ.
‘ইমাম মালিক রহ. এ আয়াত থেকে (বিভ্রান্ত বিদআতি ফিরকা) কাদরিয়া সম্প্রদায়ের সাথে শত্রুতাপোষণ ও তাদের সাথে সকল উঠাবসা বর্জন করার পক্ষে দলিল পেশ করেছেন। আশহাব রহ. ইমাম মালিক রহ. থেকে বর্ণনা করেন যে, “কাদরিয়াদের সাথে উঠাবসা কোরো না এবং আল্লাহর জন্য তাদের সাথে শত্রুতা রাখো। কারণ, আল্লাহ বলেছেন, যারা আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস করে, তাদেরকে আপনি আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের বিরুদ্ধাচরণকারীদের সাথে বন্ধুত্ব করতে দেখবেন না।” (ইমাম কুরতুবি রহ. বলেন,) আমি বলব, কাদরিয়াদের মতো সকল জালিম ও সীমালঙ্ঘনকারীরওএকই বিধান।’ (তাফসিরুল কুরতুবি : ১৭/৩০৮, প্রকাশনী : দারুল কুতুবিল মিসরিয়্যা, কায়রো)
আল্লাহ তাআলা বলেন :
قَدْ كَانَتْ لَكُمْ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ فِي إِبْرَاهِيمَ وَالَّذِينَ مَعَهُ إِذْ قَالُوا لِقَوْمِهِمْ إِنَّا بُرَآءُ مِنْكُمْ وَمِمَّا تَعْبُدُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ كَفَرْنَا بِكُمْ وَبَدَا بَيْنَنَا وَبَيْنَكُمُ الْعَدَاوَةُ وَالْبَغْضَاءُ أَبَدًا حَتَّى تُؤْمِنُوا بِاللَّهِ وَحْدَهُ إِلَّا قَوْلَ إِبْرَاهِيمَ لِأَبِيهِ لَأَسْتَغْفِرَنَّ لَكَ وَمَا أَمْلِكُ لَكَ مِنَ اللَّهِ مِنْ شَيْءٍ رَبَّنَا عَلَيْكَ تَوَكَّلْنَا وَإِلَيْكَ أَنَبْنَا وَإِلَيْكَ الْمَصِيرُ
‘তোমাদের জন্যে ইবরাহিম ও তাঁর সঙ্গীগণের মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ; যখন তাঁরা তাঁদের সম্প্রদায়কে বলেছিল, তোমাদের সাথে ও তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যার ইবাদত করো, তা থেকে আমরা সম্পর্কমুক্ত। আমরা তোমাদেরকে প্রত্যাখ্যান করলাম। আমাদের ও তোমাদের মাঝে সৃষ্টি হলো চিরশত্রুতা ও ঘৃণা; যতক্ষণ না তোমরা এক আল্লাহর প্রতি ইমান আনবে। কিন্তু ইবরাহিমের পিতার উদ্দেশ্যে তাঁর এ উক্তি “আমি অবশ্যই তোমার জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করব। আর তোমার ব্যাপারে আল্লাহর কাছে আমি কোনো অধিকার রাখি না।” এই আদর্শের ব্যতিক্রম। (ইবরাহিম ও তাঁর অনুসারীগণ বলেছিল,) হে আমাদের পালনকর্তা, আমরা তোমারই ওপর ভরসা করেছি, তোমারই দিকে মুখ করেছি এবং তোমারই নিকট আমাদের প্রত্যাবর্তন।’ (সুরা আল-মুমতাহিনা : ০৪)