‘ইদ’ (عيد) শব্দটি মূলত (عود) থেকে নির্গত। এর শাব্দিক অর্থ ফিরে আসা। ইদ বলা হয় এমন উৎসব দিবসকে, যেদিনে মানুষের সম্মেলন হয় কিংবা ফজিলতপূর্ণ বা অতীতের গুরুত্ববহ কোনো ঘটনার স্মরণ করা হয়। বলা হয়ে থাকে, যেহেতু ইদ প্রতি বছর মানুষের মাঝে নতুন আনন্দ নিয়ে ফিরে আসে, এজন্য এ দিবসকে ‘ইদ’ নামকরণ করা হয়েছে। (আল-মুনজিদ : পৃ. নং ৫৩৬, প্রকাশনী : আল-মাতবাআতুল কাসুলিকিয়্যা, বৈরুত)
মিলাদ (ميلاد) এটি আরবি ولادة শব্দ থেকে নির্গত। এর অর্থ সন্তান প্রসব করা। শব্দটি আরবি ভাষার ظرف اسم এর সিগা। শাস্ত্র অনুযায়ী ظرف اسم এর ميم যদিও জবরযুক্ত হওয়া নিয়ম, কিন্তু খেলাফে কিয়াস কখনো জেরযুক্তও ব্যবহৃত হয়। যেমন منبر (মিম্বর), مينار (মিনার) ইত্যাদি। সুতরাং ইসমে জরফ হিসেবে এর অর্থ হবে, জন্মকাল। (লিসানুল আরব : পৃ. নং ৪৯১৫, প্রকাশনী : দারুল মাআরিফ, বৈরুত; আল-মুজামুল অসিত : ২/১০৫৬)
‘ইদে মিলাদুন্নবি’ বলতে আমাদের নবি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্মবৃত্তান্ত আলোচনা করাকে বুঝানো হয়ে থাকে। অর্থাৎ, জন্মের আগমন মুহুর্ত থেকে নবুওয়াতপ্রাপ্তি পর্যন্ত বিভিন্ন ঘটনার আলোচনাকেই মিলাদ বলে।
মজার ব্যাপার হলো, শাব্দিকভাবে ‘ইদে মিলাদ’ অর্থ পবিত্র জন্মদিন হলেও অভিধানে এর ব্যববহারিক অর্থ করা হয়েছে, ক্রিসমাস হলিডে বা ইসা.-এর পবিত্র জন্মদিবস। (আল-মুনজিদ : পৃ. নং ৯১৮, প্রকাশনী : আল-মাতবাআতুল কাসুলিকিয়্যা, বৈরুত)
এতে বুঝা যায়, শব্দটি মূলত খ্রিষ্টানরা ব্যবহার করত, যা এখন নামধারী মুসলিমরা নিজেদের নবির শানে ব্যবহার করে থাকে। তাই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্মদিন বুঝাতে ‘ইদে মিলাদ’ শব্দটির ব্যবহারই সঠিক নয়। হ্যাঁ, কেউ যদি খ্রিষ্টানদের কালচার ও সংস্কৃতি গ্রহণ করতে চায়, তার কথা ভিন্ন।
মিলাদের সূচনা ও ইতিহাস :
এর প্রথমসূচনাকারী নিয়ে মতানৈক্য পরিলক্ষিত হয়। কারও মতে এ মিলাদুন্নবির সূচনাকারী হলো ফাতিমি খিলাফতের বাতিলপন্থী বাতিনি সম্প্রদায়।
শাইখ ফাহাদ আব্দুল্লাহ রহ. বলেন :
ويذكرون أن الدولة الباطنية أحدثت المولد النبوي ضمن موالد واحتفالات وأعياد أخرى كثرت مع الزمن
‘ইতিহাসবিদরা উল্লেখ করেন যে, বাতিনি সম্প্রদায় সময়ের সাথে ক্রমবর্ধমান নানা অনুষ্ঠান, উৎসব ও মিলাদের পাশাপাশি এই মিলাদুন্নবিরও প্রবর্তন করে।’ (আল-মাওলিদুন নববি বাইনাল মাশরুইয়্যাতি ওয়াল বিদআহ : ১/২, প্রকাশনী : আল-মাকতাবাতুশ শামিলা)
কারও মতে আর্বিল শহরের শাসক মুজাফফর কুকুবুরি ছিল এর প্রথম সূচনাকারী। আল্লামা সুয়ুতি রহ. বলেন :
وَأَوَّلُ مَنْ أَحْدَثَ فِعْلَ ذَلِكَ صَاحِبُ إِرْبِلَ الْمَلِكُ الْمُظَفَّرُ أَبُو سَعِيدٍ كُوكْبُرِي بْنُ زَيْنِ الدِّينِ عَلِيِّ بْنِ بَكْتَكِينَ،
‘মিলাদুন্নবি প্রথম প্রবর্তন করেন আর্বিল শহরের বাদশা মুজাফফর আবু সাইদ কুকুবুরি বিন জাইনুদ্দিন আলি বিন বাকতাকিন।’ (আল-হাবি লিল-ফাতাওয়া : ১/২২২, প্রকাশনী : দারুল ফিকর, বৈরুত)
তবে আল্লামা আবু শামা রহ.-এর বক্তব্য থেকে প্রতীয়মান হয় যে, উমর বিন মুহাম্মাদ মোল্লা নামক এক বুজুর্গ মুসেল শহরে প্রথম এ মিলাদুন্নবির প্রবর্তন করে, আর বাদশা মুজাফফর তার অনুকরণ করে। তিনি বলেন :
وَكَانَ أول من فعل ذَلِك يالموصل الشَّيْخ عمر بن مُحَمَّد الملا أحد الصَّالِحين الْمَشْهُورين وَبِه اقْتدى فِي ذَلِك صَاحب أربل وَغَيره
‘মুসেল শহরে প্রথম এ কাজটি করে প্রসিদ্ধ বুজুর্গ শাইখ উমর বিন মুহাম্মাদ মোল্লা। আর্বিলের শাসক ও অন্যরা পরে তাকেই অনুসরণ করে।’ (আল-বায়িসু আলা ইনকারিল বিদায়ি ওয়াল হাওয়াদিস : পৃ. নং ২৪, প্রকাশনী : দারুল হুদা, কায়রো)
সুতরাং মিলাদুন্নবির প্রবর্তক মূলত ফাতিমি বংশের বাতিনি সম্প্রদায়। আর মুসেল শহরে এটার প্রথম পালনকারী ছিল উমর বিন মুহাম্মাদ মোল্লা। আর আর্বিলের শাসক কুকুবুরি হলো উমর বিন মুহাম্মাদের অনুসরণকারী।
মিলাদের প্রকারভেদ :
মৌলিকভাবে মিলাদের দুটি রূপরেখা আছে। এক : স্বর্বজনস্বীকৃত মিলাদ, দুই : মতবিরোধপূর্ণ মিলাদ।
প্রথম প্রকারটি হলো, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্মের সময়কাল থেকে নিয়ে নবুওয়াত পর্যন্ত বিভিন্ন ঘটনাবলী আলোচনা করা। এ প্রকারের মিলাদকে কেউ অস্বীকার করেননি; বরং আমাদের আকাবির উলামায়ে কিরামও তা স্বীকার করেছেন।
আল্লামা রশিদ আহমদ গাঙ্গুহি রহ. বলেন :
مجلس مولود مجلس خیر وبرکت ہے در صورتیکہ قیودات مذکورہ سے خالی ہو فقط بلا قید وقت معین و بلا قیام وبغیر روایت موضوع مجلس خیر وبرکت ہے صورت موجودہ جو مروج ہے بالکل خلاف شرع ہے اور بدعت ضلالہ ہے۔
‘মিলাদ তথা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্মবৃত্তান্ত নিয়ে আলোচনার মাহফিল কল্যাণ ও বরকতের মজলিস হবে, যখন উল্লিখিত বাধ্যবাধকতা থেকে মজলিস মুক্ত থাকবে। সময় নির্দিষ্ট না করে, কিয়াম না করে এবং জাল হাদিস বর্ণনা না করলে সেটা তো কল্যাণ ও বরকতের মজলিস। কিন্তু বর্তমানের প্রচলিত পদ্ধতি পুরোপুরিই শরিয়ত পরিপন্থী এবং গোমরাহিমূলক বিদআত।’ (ফাতাওয়ায়ে রশিদিয়া : পৃ. নং ২৫৪)
তিনি আরও বলেন :
نفس ذکر ولادت منذوب ہے اس میں کراہت قیود کے سبب سے آتی۔
‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্মবৃত্তান্ত নিয়ে আলোচনা করা উত্তম কাজ। এটা মাকরুহ হয় এতে নানারকম (বিতআতি ও মনগড়া) বিষয় থাকার কারণে।’ (ফাতাওয়ায়ে রশিদিয়া : পৃ. নং ২৫৮)
তবে এটি অনুমোদিত হওয়ার জন্য শর্ত হলো তাতে কোনো ধরনের রুসুম-রেওয়াজ না থাকার পাশাপাশি আবশ্যকও মনে করা যাবে না এবং এতে অংশগ্রহণ না করলে কাউকে ভর্ৎসনা করা যাবে না। কেননা, মুসতাহাব ও বৈধ কাজে বাধ্যবাধকতা থাকলে তা বিদআতে রূপান্তরিত হয়ে যায়।
আল্লামা তিবি রহ. বলেন :
مَنْ أَصَرَّ عَلَى أَمْرٍ مَنْدُوبٍ، وَجَعَلَهُ عَزْمًا، وَلَمْ يَعْمَلْ بِالرُّخْصَةِ فَقَدْ أَصَابَ مِنْهُ الشَّيْطَانُ مِنَ الْإِضْلَالِ
‘যে ব্যক্তি কোনো মুসতাহাব বিষয়ের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করবে এবং সেটাকে আবশ্যক করে নেবে, তাহলে শয়তান তাকে গোমরাহিতে নিপতিত করল।’ (মিরকাতুল মাফাতিহ : ২/৭৫৫, প্রকাশনী : দারুল ফিকর, বৈরুত)
দ্বিতীয় প্রকারটি হলো, বিভিন্ন রুসুম, বিদআত ও কিয়ামের মাধ্যমে মিলাদ অনুষ্ঠান করা; যা আমাদের এ উপমহাদেশে বিদআতিদের মধ্যে প্রচলিত আছে।
মূলত মিলাদের বৈধতা ও অবৈধতার মূল সীমারেখাই হলো এর সাথে যুক্ত বিভিন্ন রুসুম রেওয়াজ। সে সকল রুসুম-রেওয়াজের মধ্য হতে উল্লেখযোগ্য কিছু হলো :
ক. অনির্ভরযোগ্য ও মওজু হাদিস বর্ণনার আধিক্য। অথচ হাদিসে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নামে মিথ্যা হাদিস বলার ব্যাপারে কঠোর ধমকি ও শাস্তির কথা বর্ণিত হয়েছে।
সহিহ বুখারিতে বর্ণিত হয়েছে :
عَلِيًّا، يَقُولُ: قَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: لاَ تَكْذِبُوا عَلَيَّ، فَإِنَّهُ مَنْ كَذَبَ عَلَيَّ فَلْيَلِجِ النَّارَ
‘আলি রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, তোমরা আমার ওপর মিথ্যারোপ কোরো না। কেননা, যে ব্যক্তি আমার ওপর মিথ্যরোপ করবে সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে।’ (সহিহুল বুখারি : ১/৩৩, হা. নং ১০৬, প্রকাশনী : দারু তাওকিন নাজাত, বৈরুত)
সহিহ মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে :
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: مَنْ كَذَبَ عَلَيَّ مُتَعَمِّدًا، فَلْيَتَبَوَّأْ مَقْعَدَهُ مِنَ النَّارِ
‘আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি আমার ওপর মিথ্যারোপ করবে সে তার ঠিকানা জাহান্নাম বানিয়ে নিল।’ (সহিহু মুসলিম : ১/১০, হা. নং ৩, প্রকাশনী : দারু ইহইয়াইত তুরাসিল আরাবিয়্যি, বৈরুত)
খ. মিলাদ মাহফিলগুলো সাধারণত রাত্রিকালীন হওয়ায় মানুষের ঘুম, ইবাদত ইত্যাদির ব্যাঘাত সৃষ্টি; এমনকি সারারাত এতে অংশগ্রহণ করায় অনেকবার ফজরের সালাত পর্যন্ত ছুটে যায়। অথচ ইসলামে মানুষকে অযথা কষ্ট দিতে নিষেধ করা হয়েছে।
আল্লাহ তাআলা বলেন :
وَالَّذِينَ يُؤْذُونَ الْمُؤْمِنِينَ وَالْمُؤْمِنَاتِ بِغَيْرِ مَا اكْتَسَبُوا فَقَدِ احْتَمَلُوا بُهْتَانًا وَإِثْمًا مُبِينًا
‘আর যারা বিনা অপরাধে মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীদের কষ্ট দেয়, তারা অপবাদ ও স্পষ্ট পাপের বোঝা বহন করে।’ (সুরা আল-আহজাব : ৫৮)
সহিহ বুখারিতে বর্ণিত হয়েছে :
عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَمْرٍو رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا، عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: المُسْلِمُ مَنْ سَلِمَ المُسْلِمُونَ مِنْ لِسَانِهِ وَيَدِهِ
‘আব্দুল্লাহ বিন আমর রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, প্রকৃত মুসলিম তো সেই, যার মুখ ও হাত থেকে সকল মুসলিম নিরাপদ থাকে।’ (সহিহুল বুখারি : ১/১১, হা. নং ১০, প্রকাশনী : দারু তাওকিন নাজাত, বৈরুত)
গ. মিলাদে অংশগ্রহন আবশ্যক মনে করা হয়, কেউ না করলে তাকে অপমান ও নবির দুশন ইত্যাদি বলে গালিগালাজ করা হয়। অথচ শরিয়তে বৈধ বা মুসতাহাব কাজে বাড়াবাড়ি করলে কিংবা কাজটিকে আবশ্যক মনে করলে তা বিদআতে রূপান্তরিত হয়ে যায়। সাহাবায়ে কিরাম ঐচ্ছিক বিষয়কে আবশ্যক ভাবা শয়তানের চক্রান্ত ও ধোঁকা মনে করতেন।
সহিহ বুখারিতে বর্ণিত হয়েছে :
عَنِ الأَسْوَدِ، قَالَ: قَالَ عَبْدُ اللَّهِ: لاَ يَجْعَلْ أَحَدُكُمْ لِلشَّيْطَانِ شَيْئًا مِنْ صَلاَتِهِ يَرَى أَنَّ حَقًّا عَلَيْهِ أَنْ لاَ يَنْصَرِفَ إِلَّا عَنْ يَمِينِهِ لَقَدْ رَأَيْتُ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَثِيرًا يَنْصَرِفُ عَنْ يَسَارِهِ
‘আসওয়াদ রহ. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ রা. বলেছেন, তোমাদের কেউ যেন স্বীয় সালাতের কোনো কিছু শয়তানের জন্য না বানায়। (তা হলো, ফরজ সালাতে সালাম ফেরানোর পর) সে কেবল ডান দিকে ফিরে বসাকে নিজের ওপর আবশ্যক মনে করে। অথচ আমি অনেক সময় নবি কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে বাম দিকে ফিরে বসতে দেখেছি।’ (সহিহুল বুখারি : ১/১৭০, হা. নং ৮৫২, প্রকাশনী : দারু তাওকিন নাজাত, বৈরুত)
মুল্লা আলি কারি রহ. বলেন :
قَالَ الطِّيبِيُّ: وَفِيهِ أَنَّ مَنْ أَصَرَّ عَلَى أَمْرٍ مَنْدُوبٍ، وَجَعَلَهُ عَزْمًا، وَلَمْ يَعْمَلْ بِالرُّخْصَةِ فَقَدْ أَصَابَ مِنْهُ الشَّيْطَانُ مِنَ الْإِضْلَالِ
‘আল্লামা তিবি রহ. বলেন, এ হাদিস থেকে বুঝা যায়, যে ব্যক্তি কোনো মুসতাহাব বিষয়ের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করবে এবং সেটাকে আবশ্যক করে নেবে, তাহলে শয়তান তাকে গোমরাহিতে নিপতিত করল।’ (মিরকাতুল মাফাতিহ : ২/৭৫৫, প্রকাশনী : দারুল ফিকর, বৈরুত)
ঘ. রং-বেরঙের আলোকসজ্জা, সামিয়ানা, ডেকোরেশন, খাবারের আয়োজনসহ এতে প্রচুর পরিমাণে অপচয় ও অনর্থক খরচ হয়; অথচ ইসলামে অপচয় করাকে নিষিদ্ধ করে অপচয়কারীকে শয়তানের ভাই বলে অভিহিত করা হয়েছে।
আল্লাহ তাআলা বলেন :
إِنَّ الْمُبَذِّرِينَ كَانُوا إِخْوَانَ الشَّيَاطِينِ وَكَانَ الشَّيْطَانُ لِرَبِّهِ كَفُورًا
‘নিশ্চয়ই অপব্যয়কারীরা শয়তানের ভাই। আর শয়তান স্বীয় রবের প্রতি বড়ই অকৃতজ্ঞ।’ (সুরা বনি ইসরাইল : ২৭)
ঙ. কুরআন-সুন্নাহর স্পষ্ট কোনো দলিল ছাড়াই নির্দিষ্টভাবে ১২ই রবিউল আওয়ালে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্মবৃত্তান্ত আলোচনা করাকে অধিক সওয়াবের কারণ ও উত্তম মনে করা হয়; অথচ শরিয়তের পক্ষ থেকে নির্দিষ্ট না করা থাকলে না থাকলে কোনো দিবস বা সময়কে কোনো ইবাদতের জন্য নির্দিষ্ট করা জায়িজ নয়।
সহিহ মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে :
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ، عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، قَالَ: لَا تَخْتَصُّوا لَيْلَةَ الْجُمُعَةِ بِقِيَامٍ مِنْ بَيْنِ اللَّيَالِي، وَلَا تَخُصُّوا يَوْمَ الْجُمُعَةِ بِصِيَامٍ مِنْ بَيْنِ الْأَيَّامِ، إِلَّا أَنْ يَكُونَ فِي صَوْمٍ يَصُومُهُ أَحَدُكُمْ
‘আবু হুরাইরা রা. সূত্রে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, তোমরা রাতগুলোর মাঝে কেবল জুমআর রাতকেই রাতজাগার (অর্থাৎ তাহাজ্জুদ ও নফল সালাতের) জন্য নির্দিষ্ট কোরো না, আর দিনগুলোর মাঝে শুধু জুমআর দিনকেই সিয়ামের জন্য নির্ধারিত কোরো না। তবে দিনটি যদি তোমাদের কারও নিয়মতান্ত্রিক কোনো সিয়ামের দিনে পড়ে তাহলে ভিন্ন কথা।’ (সহিহু মুসলিম : ২/৮০১, হা. নং ১১৪৪, প্রকাশনী : দারু ইহইয়াইত তুরাসিল আরাবিয়্যি, বৈরুত)
চ. এতে বিভিন্ন বিদআতি কর্মকাণ্ড ও সহিহ আকিদা পরিপন্থী গান ও কবিতা আবৃতি করা হয়। এসব কর্মকাণ্ড ও কবিতা আবৃতির দ্বারা নিজেদের কানসুখ ও মনোরঞ্জন ছাড়া রাসুলের সিরাতের শিক্ষা ও তার বাস্তবায়ন -যেটা ছিল মূল লক্ষ্য- কখনো অর্জন হয় না।
ছ. অনেক জায়গায় এসব মাহফিল ও অনুষ্ঠানে নারী-পুরুষের অবাধ যাতায়াতের সুযোগ থাকে। আর এর কারণে ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ বিধান পর্দা লঙ্ঘন হয়।
জ. মিলাদে কিয়াম করতে হয়, যা শরিয়া অনুমোদিত নয়। পাশাপাশি এতে নবিকে হাজির-নাজির মনে করা, আলিমুল গাইব বলাসহ অনেক শিরকি আকিদাও জড়িত থাকে।
ঝ. মিলাদ কিয়াম মৌখিকভাবে মুসতাহাব বললেও কাজে কর্মে কেউ মিলাদ কিয়াম না করলে তাকে ভর্ৎসনা করা হয় ও বাঁকা দৃষ্টিতে দেখা হয়।
ঞ. মিলাদ মাহফিলে হাদিস দ্বারা প্রমাণিত সহিহ দরুদ পাঠ না করে নিজেদের বানানো দরুদ পাঠ করা হয়।
এছাড়াও এতে আরও নানারকম রুসুম-রেওয়াজ বিদ্যমান, যা প্রচলিত ইদে মিলাদুন্নবি পালন বিদআত হওয়াকে সুনিশ্চিত করে। এজন্যই যুগে যুগে বিজ্ঞ উলামায়ে কিরাম এটাকে গর্হিত বিদআত আখ্যা দিয়ে আসছেন। আল্লাহ আমাদের সব ধরনের বিদআত ও রুসুম পালন থেকে দূরে রাখুন।
মিলাদুন্নবির পক্ষের দলিলাদি ও তার খণ্ডন
১ নং দলিল :
আল্লাহ তাআলা বলেন :
قُلْ بِفَضْلِ اللّهِ وَبِرَحْمَتِهِ فَبِذَلِكَ فَلْيَفْرَحُواْ
‘আপনি বলুন, এটা (এসেছে) আল্লাহর অনুগ্রহ ও রহমতে। অতএব, তারা যেন এতে আনন্দিত হয়। (সুরা ইউনুস : ৫৮)
উক্ত আয়াতে ‘রহমত’ দ্বারা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উদ্দেশ্য। যেহেতু অন্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা তাঁর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে ‘রহমত’ বলে অভিহিত করেছেন, সুতরাং এখানেও ‘রহমত’ দ্বারা আল্লাহর রাসুলই উদ্দেশ্য হবেন। এরপর উক্ত আয়াতে আল্লাহ তাআলা এর কারণে খুশি উদযাপন করতে বলেছেন। আর মিলাদ মাহফিলের মাধ্যমে তো সেই খুশিই প্রকাশ করা হয়। তাই এটা বিদআত হওয়ার প্রশ্নই আসে না; বরং এটা হলো কুরআনি নির্দেশনা। যারা এটা অস্বীকার করবে, তারা কুরআনবিরোধী, তারা রিসালাহবিরোধী, তারা আল্লাহ ও তাঁর নবির দুশমন।
খণ্ডন :
প্রথমত, এ আয়াত দ্বারা তাদের দলিল দেওয়াই ভুল। কেননা, আয়াতে উদ্ধৃত ‘রহমত’ দ্বারা যদি নিশ্চিত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উদ্দেশ্য হতেন, তাহলে নাহয় একটা কথা ছিল, কিন্তু এটা তো মতানৈক্যপূর্ণ একটি বিষয়। এ আয়াতে ‘রহমত’ দ্বারা নবি উদ্দেশ্য নাকি অন্য কিছু, সে ব্যাপারে মুফাসসিরদের মাঝে মতভেদ রয়েছে। উম্মাহর শ্রেষ্ঠ মুফাসসির ইবনে আব্বাস রা., এছাড়াও আবু সাইদ খুদরি রা., আনাস রা. বারা রা.-সহ অধিকাংশ সাহাবি ও তাবিয়ি মুফাসসিরদের মত হলো, এখানে ‘রহমত’ দ্বারা নবি উদ্দেশ্য নয়; বরং ইসলাম, ইমান বা কুরআন উদ্দেশ্য।
ইমাম কুরতুবি রহ. বলেন :
قَوْلُهُ تَعَالَى: (قُلْ بِفَضْلِ اللَّهِ وَبِرَحْمَتِهِ) قَالَ أَبُو سَعِيدٍ الْخُدْرِيُّ وَابْنُ عَبَّاسٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا: فَضْلُ اللَّهِ الْقُرْآنُ، وَرَحْمَتُهُ الْإِسْلَامُ. وَعَنْهُمَا أَيْضًا: فَضْلُ اللَّهِ الْقُرْآنُ، وَرَحْمَتُهُ أَنْ جَعَلَكُمْ مِنْ أَهْلِهِ. وَعَنِ الْحَسَنِ وَالضَّحَّاكِ وَمُجَاهِدٍ وَقَتَادَةَ: فَضْلُ اللَّهِ الْإِيمَانُ، وَرَحْمَتُهُ الْقُرْآنُ، عَلَى الْعَكْسِ مِنَ الْقَوْلِ الْأَوَّلِ. وَقِيلَ: غَيْرُ هَذَا.
‘আল্লাহ তাআলার বাণী “আপনি বলুন, এটা (এসেছে) আল্লাহর অনুগ্রহ ও রহমতে” : আবু সাইদ খুদরি রা. ও ইবনে আব্বাস রা. বলেন, আল্লাহর অনুগ্রহ হলো ইমান, আর তাঁর রহমত হলো ইসলাম। তাঁদের দুজন থেকে আরও বর্ণিত হয়েছে যে, আল্লাহর অনুগ্রহ হলো কুরআন, আর তাঁর রহমত হলো, তোমাদেরকে কুরআনের অনুসারী বানানো। আর প্রথম মতের উল্টো হাসান বসরি রহ., জাহহাক রহ., মুজাহিদ রহ. ও কাতাদা রহ. থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, আল্লাহর অনুগ্রহ হলো ইমান, আর তাঁর রহমত হলো কুরআন। এছাড়াও এতে আরও কিছু মত আছে।’ (তাফসিরুল কুরতুবি : ৮/৩৫৩, প্রকাশনী : দারুল কুতুবিল মিসরিয়্যা, কায়রো)
ইমাম তাবারি রহ. আয়াতটির অর্থ করেছেন :
يَقُولُ تَعَالَى ذِكْرُهُ لِنَبِيِّهِ مُحَمَّدٍ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: {قُلْ} يَا مُحَمَّدُ لِهَؤُلَاءِ المكذِّبين بِكَ وَبِمَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ مِنْ عِنْدِ رَبِّكَ: {بِفَضْلِ اللَّهِ} أَيُّهَا النَّاسُ الَّذِي تَفَضَّلَ بِهِ عَلَيْكُمْ، وَهُوَ الْإِسْلَامُ، فَبَيَّنَهُ لَكَمْ وَدَعَاكُمْ إِلَيْهِ، {وَبِرَحْمَتِهِ} الَّتِي رَحِمَكُمْ بِهَا، فَأَنْزَلَهَا إِلَيْكُمْ، فَعَلَّمَكُمْ مَا لَمْ تَكُونُوا تَعْلَمُونَ مِنْ كِتَابِهِ، وَبَصَّرَكُمْ بِهَا مَعَالِمَ دِينِكُمْ؛ وَذَلِكَ الْقُرْآنُ.
‘আল্লাহ তাআলা তাঁর নবিকে উদ্দেশ্য করে বলেন, “বলুন” হে মুহাম্মাদ, ওইসব লোকদের উদ্দেশ্যে, যারা আপনাকে ও আপনার রবের পক্ষ থেকে যা নাজিলকৃত অহিকে অস্বীকার করে, হে লোকসকল, “আল্লাহর অনুগ্রহে” যদ্বারা তিনি তোমাদের ওপর অনুগ্রহ করেছেন, আর সেটা হলো ইসলাম। সুতরাং তিনি তোমাদেরকে স্পষ্ট করে বর্ণনা করেছেন এবং সেদিকে তোমাদের আহবান করেছেন। আর “তাঁর রহমতে” যদ্বারা তিনি তোমাদের ওপর দয়া করেছেন, এরপর তোমাদের প্রতি রহমত নাজিল করেছেন, অতঃপর তোমরা যা জানতে না, তোমাদের সেই কিতাব শিক্ষা দিয়েছেন এবং তোমাদের দ্বীনের রূপরেখা ও পথ দেখিয়েছেন, আর সেটা হলো কুরআন।’ (তাফসিরুত তাবারি : ১৫/১০৫, প্রকাশনী : মুআসসাসাতুর রিসালা, বৈরুত)
দ্বিতীয়ত, কিছু মুফাসসিরদের মত অনুযায়ী রহমত দ্বারা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উদ্দেশ্য হলেও কোনো অসুবিধা নেই। কেননা, এতে আনন্দিত হওয়ার আদেশ দেওয়া হয়েছে, কিন্তু প্রকাশ করা বা এর পদ্ধতি নিয়ে কিছু বলা হয়নি। অথচ আমাদের আলোচ্যবিষয় আনন্দিত হওয়া নিয়ে নয়; বরং প্রচলিত নিয়মে আনন্দ প্রকাশ করার ধরণ নিয়ে। তাই এ আয়াত দ্বারা প্রচলিত নিয়মের মিলাদকে প্রমাণ করার কোনো অবকাশ নেই।
তৃতীয়ত, বিদআতিদের ভাষ্যনুসারে এ আয়াতের দ্বারা যদি প্রচলিত মিলাদ সাব্যস্ত করাই হয়, তাহলে তো দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টা মিলে সারামাস ও সারাবছরই মিলাদ পালন করা উচিত। কেননা, এখানে মিলাদের মাধ্যমে খুশি প্রকাশ করা হচ্ছে মালুল (معلول) বা বিধান, আর তার ইল্লত (علة) বা কারণ হলো, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর অস্থিত। নিয়ম হলো, ইল্লত বিদ্যমান থাকলে তার মালুল বা বিধানও বহাল থাকবে। সুতরাং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্মের পর থেকে যেহেতু তিনি অস্থিত্বলাভ করেছেন এবং এখনও তাঁর অস্তিত্ব বহাল আছে, বিধায় সর্বদাই তার মালুল তথা মিলাদ পালন করাটাও সাব্যস্ত হয়ে যাচ্ছে। যদি কেউ বলে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ইনতিকালের পর তো দুনিয়াতে তাঁর অস্তিত্ব নেই, তাই সর্বদা করার কোনো প্রয়োজন নেই, তাহলে আমরা উত্তরে বলব, আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের সর্বসম্মত আকিদা হলো, আম্বিয়ায়ে কিরাম সবাই স্ব স্ব কবরে জীবিত আছেন। সুতরাং নিজেদের বাতিল মতের ওপর উত্থাপিত আপত্তি থেকে বাঁচতে তাঁকে অস্তিত্বহীন বলাটা নবির শানে মারাত্মক বেআদবি, যা আশেকে রাসুল দাবিদারদের সাথে কিছুতেই মানানসই নয়। দ্বিতীয়ত, যদি তাঁকে দুনিয়ার জীবনে মৃত্যু হয়েছে বিধায় অস্তিত্বহীন বলে, তাহলে আমরা বলব, সেক্ষেত্রে তোমাদের মিলাদ পালনেরও কোনো অধিকার নেই। কেননা, তাঁর অস্তিত্বের ভিত্তিতেই বিধান বলা হয়েছিল। সুতরাং যখন অস্তিত্বই নেই তখন বিধানও বাকি থাকবে না। মোটকথা এ আয়াত থেকে মিলাদ প্রমাণ করতে গেলে তাদের এ দুটির যেকোনো একটি মেনে নিতেই হবে—হয় সারাবছর মিলাদ পালন করবে, নয়তো একেবারেই করবে না। গোলমেলে উত্তর দিয়ে মাঝামাঝি থাকার কোনো সুযোগ নেই।
চতুর্থত, আয়াতে আমরের সিগা (নির্দেশসূচক ক্রিয়া) ব্যবহার করা হয়েছে, যা কাজকে বিশেষ ব্যতিক্রম ছাড়া সম্বোধিত ব্যক্তির ওপর আবশ্যক করে দেয়। অথচ আমাদের জানামতে বিদআতি আলিমরা মিলাদুন্নবি পালনকে আবশ্যক বলে না; বরং তারাও এটাকে মুসতাহাব বা মুসতাহসান বলে। এ আয়াতে বিশেষ কোনো ব্যতিক্রম এর দলিল না থাকা সত্ত্বেও যখন কেউই মিলাদ পালনকে ওয়াজিব বা ফরজ বলেনি, বুঝা গেলো এখানে মিলাদের কথা বলা হয়নি। নতুবা আমরের সিগার নিয়মানুসারে তা আবশ্যক হয়ে যেত। সুতরাং এ আয়াত দ্বারা প্রচলিত মিলাদুন্নবি প্রমাণ করা ভুল, যাকে তারা মুসতাহাব বলে প্রচার করে। তবে কেউ যদি হঠকারিতা করে এ আয়াত থেকে মিলাদকে আবশ্যক বলে দেয়, তাহলে সে আরও বড় বিপদ ও আপত্তির মুখে পড়বে, যা আহলে ইলমদের অজানা নয়।